User:Md. Habibullah Language Activist

From Wikipedia, the free encyclopedia

মোঃ হাবীবুল্লাহ ভাষা সৈনিক (১৯৩০-২০১১)

মোঃ হাবীবুল্লাহ এ জনপদের একটি বিশিষ্ট ও উজ্জ্বল নাম । তিনি সন্ধ্যাবিধৌত সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা স্বরূপকাঠী থানার বর্তমানে নেছারাবাদ উপজেলার জগন্নাথকাঠী গ্রামে ১৯৩০ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । পিতা- মোঃ আফছার উদ্দীন, মাতা-হাজেরা খাতুন । দক্ষিন বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ আকলম মুসলিম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষায় অবিভক্ত ভারতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি সপ্তম শ্রেণীতে বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫০ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন । ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পরে তিনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বরিশাল সরকারি বি.এম কলেজে ভর্তি হন । উক্ত কলেজ হতে তিনি ১৯৫২ সালে আই.এ ও ১৯৫৪ সালে বি.এ পরীক্ষায় স্বগৌরবে উত্তীর্ণ হন। বি.এম কলেজে অধ্যয়ন কালে ১৯৫২-৫৩ সালে তিনি ছাত্র সংসদের ভি.পি নির্বাচিত হন। ছাত্রদের কল্যান ও কলেজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন । আর এজন্য তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি তাঁর এক বন্ধুর পটুয়াখালির গ্রামের বাড়িতে আত্মগোপন করে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বি.এড ডিগ্রি (১৯৬৭) লাভ করেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হতে।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অনিবার্য কারনে শেষ পর্যন্ত তাঁর আইনের চূড়ান্ত ডিগ্রি নেওয়া হয়নি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ঢাকা কুর্মিটোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি তাঁর নিজ জন্মস্থান স্বরূপকাঠীর শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন।তিনি ছিলেন স্বরূপকাঠী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। এ স্কুলে দীর্ঘকাল তিনি সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেন। নারী শিক্ষার উন্নয়নে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরোধীতা উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করেন কামারকাঠি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কামারকাঠি নবকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহনে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করে। যুদ্ধরত ছাত্রদের সাথে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।


স্বরূপকাঠিতে শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা প্রবাদ প্রতীম। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বানড়ীপাড়া পাইলট স্কুল, উজিরপুরের হাবিবপুর উচ্চবিদ্যালয় , আকলম মুসলিম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কামারকাঠী নবকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দক্ষতা ও সুনামের সাথে পালন করেন। তাঁর কর্মকালীন সময়ে স্কুলের ফলাফল ছিল ঈর্ষণীয়। সুদর্শন,বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও ইংরেজি ভাষায় পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্বেও তিনি সরকারী চাকুরীর মোহ পরিত্যাগ করে শিক্ষকতার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।তিনি ছিলেন প্রত্যয়ের ভাস্কর। তাই শিক্ষক জীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছিলেন বিপুল স্বার্থকতায়। উচ্চবিলাসী জীবনের মোহ মায়াকে দুপায়ে মাড়িয়ে শিক্ষা বিস্তারে হেঁটে চলেছেন সংশপ্তকের মত।


শিক্ষক সমিতির একজন নেতা হিসেবে বেসরকারী স্কুল শিক্ষকদের নানাবিধ সমস্যা,বঞ্চনা, দুরবস্থা ও বৈষম্য প্রতিকারের লক্ষ্যে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। শিক্ষকদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে তিনি আত্মমর্যাদা ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের উপর গুরত্ব আরোপ করতেন।শিক্ষক সমাজ বিপুল উৎসাহভরে তার কথা শুনতেনএবং অনুপ্রানিত হতেন। উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কাউট আন্দোলনেও তিনি ভূমিকা রাখেন। তিনি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরাগী ও ভক্ত ছিলেন। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাঁর লেখা কবিতা, প্রবন্ধ স্কুল ম্যাগাজিন, নানা সাহিত্য সাময়িকী ও যৌথ গ্রন্থে সগৌরবে প্রকাশিত হয়েছে।“কবিতা কুঞ্জ” তার স্বল্প পরিসরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। জুড়িবোর্ডের সম্মানিত সদস্য হিসেবে আদালতে গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তির সময় উপস্থিত থাকার সুযোগ তাঁর হয়েছে। বেসরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে অবসরকালীন পেনশন হিসেবে প্রাপ্ত সমুদয় টাকা জন্মভিটায় তাঁর ও অন্যান্যদের দানকৃত জমিতে স্থাপিত জগন্নাথকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দান করেন এবং স্কুলের শিক্ষকদের জন্য অফিস কক্ষ সেমিপাকা টিনসেড দ্বারা নির্মান করেন।তিনি তাঁর স্ত্রী তেজঁগাও পলিটেকনিক উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষিকা মিসেস যোবেদা খাতুনের নামে “যোবেদা সেবা” ফান্ড খোলেন।

যেখান থেকে অতি দরিদ্রকে স্বল্পপরিসরে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ করে দেন। স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার লক্ষ্যে তিনিএকটি আর্থিক ফান্ডও খোলেন।শিক্ষা বিস্তারে তাঁর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা চোখে পড়ার মত।

তিনি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ছ্ত্রা। তার অসংখ্য ছাত্র সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন। তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র বরেণ্য লেখক, সাহিত্য সমালোচক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিভাবান অধ্যাপক ডঃ বিশ্বজিৎঘোষ তাঁর “জীবনানন্দ জসীমউদ্দীন এবং” নামের বিখ্যাত বই এবং দেশের অন্যতম প্রধাণ কবি ওমর আলী তাঁর ক্লাসিক সাহিত্যকর্ম “ও যধাব যবধৎফ ঃযব ফধৎশ ংশরহহবফ ড়িসবহ’ং ড়ভ ঃযরং পড়ঁহঃৎু” তাঁকে উৎসর্গ করেন। মোঃ হাবিবুল্লার শৈশবে কলকাতা শহরে বেড়ানোর হিরন্ময় স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। সীমান্তগান্ধী খান আব্দুল গাফফার খান, শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হক , মাওলানা ভাষানী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহু বরেণ্য নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।

ছোট বেলায় তিনি ছিলেন ফুটফুটে চঞ্চল। হাঁটা-চলা , কথা-বার্তা সবকিছুর মধ্যে ছিল স্বাতন্ত্রবোধ । পরবর্তী যাপিত জীবনেও তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়েও আলাদা। তাঁর ৮০ বছরের দীর্ঘ জীবন ছিল বলিষ্ঠ ও বর্নাঢ্য।তেজস্বিতা ,নৈতিকতা ,স্বচ্ছতার জন্য তার বেশ পরিচিতি ছিল।তাঁর মত স্পষ্টভাষী, দুর্নীতিমুক্ত ,ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, কর্মবীর ও নীতিবান ব্যক্তির সন্ধান মেলা ভার।আত্মপ্রচার বিমূখ এই ব্যক্তিটি কারও প্রশংসা,তুষ্টি বা দৃষ্টি আর্কষনের জন্য কাজ করতেন না। তিনি প্রশংসায় উদ্বেল বা নিন্দায় বিচলিত হতেন না। তিনি কাজ করেছেন, জ্ঞানের বৃক্ষ রোপন করেছেন পেশাগত উৎকর্ষতায় এবং দেশপ্রমের গভীর আনন্দে।

আদর্শ শিক্ষক,বিশ্বস্ত অভিভাবক, সংস্কৃতিসেবী, স্কুল পরিচালনায় সুদক্ষ প্রশাসক ও একজন অগ্রসর চিন্তার মানুষ হিসাবে তিনি সমধিক পরিচিত। স্বতন্ত্র জীবনচেতনার প্রসার ঘটিয়েছেন সমাজ জীবনে, রেখেছেন নানা উজ্জ্বল কীর্তির স্বাক্ষর । মুক্ত বুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আপন জীবন প্রবাহে। তাঁর চিত্তলোক ছিল জ্ঞান বিস্তারের চেতনায় উদ্ভাসিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনমনীয়, সাহসী অবস্থান ছিল তাঁর। অকৃপন জ্ঞানের আলোক দানে অনেকে হয়েছে ধন্য ও ঋদ্ধুুু। ধর্মীয় সংস্কারের কাছে কখনও তিনি বন্দী হননি।


নানা দিক বিবেচনায় তিনি ছিলেন এক দীপ্যমান ব্যক্তিত্ব।তিনি সাধারণ-অসাধারণ। অনিশ্চিত জীবনের নিশ্চিত পূর্ণবিরতিই হলো মৃত্যু। মৃত্যুকে উপেক্ষা করার শক্তি কারও নেই।১৭ অক্টোবর ২০১১ তারিখ সকাল ৬.৩০ মিনিট সময় তিনি তাঁর স্মৃতিময়, ও প্রিয় শহর ঢাকায় পরলোক গমন করেন।

তাঁর মৃত্যুতে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক উজ্জ¦ল আলো নিভে গেল। উন্নত আদর্শের এক বৃক্ষ যেন হারিয়ে গেল। তাঁর অভাব সহজে পূরণ হবার নয়। তিনি ছয় পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক । তাঁর সন্তানেরা সুশিক্ষিত, প্রতিভাবান ও স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল। এই নির্লোভ ,নির্মোহ মানুষটিকে স্বরূপমাতার নিসর্গ ও প্রিয় মৃত্তিকা মন্ত্রমুগ্ধের মত আকর্ষণ করেছে সারা জীবন। তাই শিক্ষা জীবন ও অন্যত্র সামান্য কর্মজীবন বাদে জীবনের পুরোটা সময়ই কাটিয়েছেন শ্যামল মৃত্তিকার টানে। তিনি ছিলেন শিকড় সন্ধানী। তাঁর অভাব সহজে পূরণ হবার নয়। আমাদের প্রার্থণা তাঁর বিদেহী আত্মা অপার শান্তিতে থাকুক এবং তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকুন মানুষের মনের মুকুরে।